যাঁরা 'রসগোল্লা' পড়েছেন তাঁরা তো বটেই, অন্য যাঁদের রম্য লেখার কথা মনে হয়, শুরুতেই তাঁদের মনে পড়বে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। বিশেষ করে এই বাংলায়। যদিও বঙ্কিমচন্দ্র বা প্রমথ চৌধুরী তত দিনে বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু 'রম্য সাহিত্য' নতুন বৈশিষ্ট্য পেয়েছে মুজতবা আলীর হাতে। রম্য লেখক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত সৈয়দ মুজতবা আলী। যদিও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তাঁর প্রভাব বেশ বলিষ্ঠ।
সৈয়দ মুজতবা আলী একজন লেখক, শিক্ষক, ভাষাবিদ, সংগঠক। সর্বোপরি একজন সফল মানুষ। ১৯৭৪ সালের এই দিনে রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। জন্ম হয় ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, সিলেটের করিমগঞ্জ শহরে। দেশ ভাগের পর করিমগঞ্জ ভারতের আসামের মধ্যে পড়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর বাড়ি হবিগঞ্জে। বাবা সৈয়দ সিকান্দার আলী ছিলেন সরকারি চাকুরে। যে কারণে তাঁদের পরিবারের স্থায়ীভাবে বসবাস করা হয়নি কোথাও। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনাও হয়েছে তাই সিলেটের বিভিন্ন এলাকায়। ১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসেন সিলেটে। এ সময় পড়াশোনায় আগ্রহ আর সাহিত্যে দখল থাকার কারণে মুজতবা আলী কবিগুরুর চোখে পড়েন। কবি সঙ্গে করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান তাঁকে।
১৯২১ সালে ভর্তি হওয়ার পর ১৯২৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। মুজতবা আলী বিশ্বভারতীর প্রথম দিকের ছাত্র। এখানেই তিনি শেখেন ইংরেজি, আরবি, ফারসি, সংস্কৃতি, গুজরাটি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষা। বিশ্বভারতীর পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে দর্শন পড়েন জার্মানির বনে। সেখান থেকে ১৯৩২ সালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে অর্জন করেন ডি-ফিল ডিগ্রি। পরে তিনি আরো পড়াশোনা করেন মিসরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্বভারতীতে পড়তে পড়তেই মুজতবা আলী জড়িয়ে পড়েন লেখালেখির সঙ্গে। নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতেন নামে অথবা ছদ্মনামে। আলীগড়ের পড়াশোনা শেষ করেই যোগ দেন কাবুলের একটি কলেজে। সেখানে তিনি ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখাতেন। ১৯৩৫ সালে বরোদা মহারাজার আমন্ত্রণে যোগ দেন বরোদা কলেজে। এখানে তিনি টানা আট বছর তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব পড়ান। এরপর দিল্লিতে যোগ দেন ভারতীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।
সরকারি চাকরি বেশি দিন ভালো লাগেনি মুজতবা আলীর। চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। এই সময়টাই ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার শ্রেষ্ঠ সময়।
১৯৪৯ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন বগুড়া আযিযুল হক কলেজে। অবশ্য এখানেও বেশি দিন ছিলেন না তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ সময় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদের আমন্ত্রণে সচিব হিসেবে যোগ দেন ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেসান্সে। এর পর পরিচালক হিসেবে যোগ দেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। রেডিওর চাকরিতে ইস্তফা দেন ১৯৫৬ সালে। টানা চার বছর শুধু লেখালেখি করেই কাটান।
১৯৬১ সালে আবারও ফিরে আসেন বিশ্বভারতীতে। রম্য রচনা ছাড়া ভ্রমণ কাহিনীতেও অনবদ্য ছিলেন মুজতবা আলী। পড়াশোনা ও চাকরি সূত্রে তিনি বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকবার। বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের কারণে ১৯৪৯ সালে তিনি অর্জন করেন নরসিং দাস পুরস্কার। এ ছাড়া ১৯৬১ সালে অর্জন করেন আনন্দ পুরস্কার।
Read online or Download this book
সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ - ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) একজন বিংশ শতকী বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা। তিনি তাঁর রম্য রচনা ও ভ্রমণকাহিনীগুলির জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধে পরিপুষ্ট। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানের বিশ্বভারতী নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন। পরবর্তীতে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায়, যেমন : দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতিতে কলাম লিখেন। তাঁর বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমনকাহিনী। এছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হল, "বই পড়ে কেউ দেউলিয়া হয়না।" তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ৩০।
বিস্তারিত